Monday, October 3, 2016

জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ এম খান স্যার চিকিৎসা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

সদ্য কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে এসে সাতক্ষীরায় প্র্যক্টিস করেন ডাঃমোঃ রফি খান। ভিজিট ৪ টাকা।
সময়টা গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক। অল্প সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই তরুন চিকিতসককে স্থানীয় লোকজন ধরে পৌরসভা নির্বাচনে দাড়া করিয়ে দিলেন। যথারীতি নির্বাচনে তিনি হেরেও গেলেন।
একটু অভিমান করে ভদ্রলোক পাড়ি দিলেন উচ্চশিক্ষার জন্যে বিলেতে। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমআরসিপি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলেন ১৯৬৩ সালে। বিলেতিরা তাকে ছাড়তে রাজি না । তিনি তাদের বললেনঃ "এ দেশে আমার মতো আরও অনেক ডাঃ মোঃ রফি খান আছেন। আমার দেশে শিশু চিকিত্সকের বড় সংকট। আমাকে ফিরতেই হবে। "
ফিরলেন তিনি। সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এক বছর পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজে বদলি হয়ে এলেন। স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগ থেকে চারটি বিছানা (বেড) ধার করে কাজ শুরু করলেন " শিশুস্বাস্থ্য " বিভাগের। তখন রাজশাহী ছোট্ট শহর—কাদার শহর, মশা-মাছির শহর। স্ত্রীর শরীর খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু তিনি নীতিবান মানুষ, বদলির তদবির করতে বিবেকে বাধে। পাঁচ বছর রাজশাহীতে ‘অজ্ঞাতবাস’ করে ঢাকা মেডিকেলে ফিরলেন ১৯৬৯ সালে।
১৯৭০ সালে পেলেন ঈপ্সিত সম্মান, অধ্যাপক পদ। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে তিনিই পেডিয়াট্রিকসের প্রথম অধ্যাপক। ১৯৬৫ সালে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত চেম্বারে টিকা দিতে শুরু করেছিলেন। এখন বাংলাদেশের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি সারা বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশ পোলিওমুক্ত। ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী নিধন তালিকায় তাঁর নামও ছিল। ভাগ্য ভালো, রাজাকারেরা তাঁর নাগাল পায়নি।
স্বাধীনতার পর পরিত্যক্ত শাহবাগ হোটেলে আইপিজিএমআর এ বাংলাদেশে মেডিকেল শিক্ষায় পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কার্যক্রম শুরু হল। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিত্সক প্রফেসর নূরুল ইসলাম হলেন এর পরিচালক।
তাঁর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত হলেন প্রফেসর ডাঃমোঃ রফি খান। সেই যে পিজির হাল ধরলেন, ছাড়লেন টানা ১৮ বছর পর, ১৯৮৮ সালে। এর মধ্যে এডিনবরা থেকে এফআরসিপি ডিগ্রিও অর্জন করলেন।
একবার মজা করে বললেনঃ "একটা সময় ছিল আমরা শিশুদের কোর্সে ছাত্র ভর্তি করব বলে চারজন পরীক্ষক বসে আছি, প্রার্থী এসেছে একজন। আর এখন শত শত ছাত্র, ভর্তির চেষ্টা করে। কেউ টেকে, কেউ অকৃতকার্য হয়।"
অবসর নেওয়ার পর অধিকাংশ মানুষ বুড়িয়ে যায়। শরীর চলতে চায় না, মন থাকে অবসাদগ্রস্ত। অথচ ডাঃ মোঃ রফি খানের বেলায় হলো উল্টো। তাঁর দিন শুরু হয় ভোর পাঁচটায়। ভোরের নামাজ শেষে বাড়ির ছাদে কিছুক্ষণ পায়চারি করেন। সেখানে একটি পাত্রে তিনি পাখির জন্য পানি ঢেলে রাখেন। কাক, শালিক, চড়ুই এসে বসে। ছাদে কিছু গাছগাছালি আছে, দুজনে এগুলোর পরিচর্যা করেন। নিচে নেমে কিছুক্ষণ কোরআন শরিফ ও হাদিস পড়েন। এরপর নাশতা শেষে টেলিভিশনে খবর দেখতে দেখতে দৈনিক পত্রিকা পড়ে ফেলেন।
নয়টার মধ্যেই ঢুকে পড়েন নৈমিত্তিক কর্মযজ্ঞে—নিবেদিতা নার্সিং হোম, সেন্ট্রাল হাসপাতাল, মহিলা মেডিকেল কলেজ ও শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনে যান রোগী দেখতে।
এসব প্রতিষ্ঠান তাঁর হাতেগড়া। এর বাইরেও রোগী দেখেন আইসিডিডিআরবির মতো আন্তর্জাতিক চিকিত্সা গবেষণাকেন্দ্রে।
সমাজসেবা তার ব্রত। পেনশানের টাকা দিয়ে মা ও শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক সম্মাননায় ভূষিত করেছে, পেয়েছেন একুশে পদক।
ডাঃ মোঃ রফি খান নামটা অপরিচিত লাগছে?
সংক্ষেপে ডাঃ এম আর খান। এই নামেই সবাই তাকে চেনেন।ডাঃ মোঃ রফি খান থেকে জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ এম আর খান হয়ে ওঠা এই শিশু বন্ধুর আজ ৮৮ তম জন্মদিন। স্যালুট, এই মহান মানুষটিকে ৷

সৌজন্যে ০--- ডা. সরওয়ার আলম শাংকু ।




            জাতীয় অধ্যাপক এম.আর.খান স্যারের 
     জীবন বৃত্তান্ত সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো ...ডাঃ স্বাধীন

এম আর খান (জন্ম: ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট , মৃত্যু -৫ নভেম্বর রোজ শনিবার ২০১৬ ) বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা অধ্যাপক, চিকিৎসক, শিশুবিশেষজ্ঞ। এম আর খান নামে তিনি সর্বাধিক পরিচিত হলেও তাঁর পুরো নাম মো. রফি খান। বাবা মা, প্রতিবেশী সকলের কাছে খোকা নামে বেশী পরিচিত ছিলেন তিনি। তিনি সরকার কর্তৃক দেশের জাতীয় অধ্যাপক নির্বাচিত হয়েছেন।

জন্ম ও শিক্ষাজীবন

এম আর খানের জন্ম ১৯২৮ সালের ১ আগস্টে সাতক্ষীরায়। বাবা আলহাজ্ব আব্দুল বারী খান, মা জায়েরা খানম। তাঁদের চার ছেলের মধ্যে তিনি ছিলেন মেজ। মায়ের হাতে পড়াশুনার হাতেখড়ি হয়। এরপর রসুলপুর প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হন। সাতক্ষীরা সদরের প্রাণনাথ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় (পিএন স্কুল)-এ ভর্তি হন তিনি। পড়াশুনায় মেধাবী ছিলেন খুব। ছেলেবেলায় খুব ভাল ফুটবল খেলতেন। রসুলপুর স্কুল টিম লিডার হিসেবে তিনি ১৩টি ট্রফি লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে এ স্কুল থেকেই কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। মেট্রিক পাস করার পর তিনি কলকাতায়যান। ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯৪৫ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৪৬ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর সাতক্ষীরায় ফিরে আসেন তিনি। এরপর ১৯৫৬ সালে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি লন্ডনে পাড়ি জমান এবং বৃটেনের এডিনবার্গ স্কুল অব মেডিসিন-এ ভর্তি হন। সেখান থেকে একই সালে ডিপ্লোমা ইন ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন (ডিটিএমএন্ডএইচ) ডিগ্রী লাভ করেন। স্কুল অব মেডিসিন লন্ডন থেকে তিনি ডিপ্লোমা ইন চাইল্ড হেলথ (ডিসিএইচ) ডিগ্রিও লাভ করেন। ১৯৬২ সালে 'এডিনবার্গের রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান' থেকে তিনি এমআরসিপি ডিগ্রি লাভ করেন।১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ফেলো অব কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জন (এফসিপিএস) এবং ১৯৭৮ সালে এডিনবার্গ থেকে ফেলো অব রয়েল কলেজ অ্যান্ড ফিজিশিয়ানস (এফআরসিপি) ডিগ্রি লাভ করেন।

পরিবার

রসুলপুর গ্রামের মেয়ে এম আর খানের দূর সম্পর্কের আত্মীয় আনোয়ারা বেগম আনুর সাথে ১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আনোয়ারা বেগম ও ডা. এম আর খান দম্পতির একমাত্র মেয়ের নাম দৌলতুন্নেসা (ম্যান্ডি)।

কর্মজীবন

১৯৫২ সালে কলিকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর সাতক্ষীরায় ফিরে আসেন এম আর খান। উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ১৯৫৬ সালে তিনি সস্ত্রীক বিদেশে পাড়ি জমান। বিদেশে পড়াশুনা শেষ করে তিনি ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার কেন্ট এবং এডিনবার্গ গ্রুপ হাসপাতালে যথাক্রমে সহকারী রেজিস্টার ও রেজিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসোসিয়েট প্রফেসর অব মেডিসিন পদে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (শিশুস্বাস্থ্য) পদে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগে যোগ দেন এবং এক বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৭০ সালে তিনি অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি পান। ১৯৭১ সালে তিনি ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিসিন এন্ড রিসার্চ (আইপিজিএমআর)-এর অধ্যাপক ও১৯৭৩ সালে এই ইনস্টিটিউটের যুগ্ম-পরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের নভেম্বরে তিনি ঢাকা শিশু হাসপাতালে অধ্যাপক ও পরিচালকের পদে যোগদান করেন। একই বছরে পুনরায় তিনি আইপিজিএমআর-এর শিশু বিভাগের অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং দক্ষতা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালে অধ্যাপক ডা. এম আর খান তাঁর সুদীর্ঘ চাকুরী জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

পুরস্কার প্রদান

পেনশনের টাকা দিয়ে মা ও শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন ডা. এম আর খান ও আনোয়ারা ট্রাস্ট। এ ট্রাস্ট থেকে শিশু স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় অনুদান, হাসপাতাল ও স্কুল প্রতিষ্ঠা, মেধাবী ও গরিব শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে ভালো অবদানের জন্য দেয়া হয় ডা. এম আর খান ও আনোয়ারা ট্রাস্ট স্বর্ণপদক। । ২০১১ সালে এ স্বর্ণপদক পেয়েছেন কমিউনিটি মাদার এ্যান্ড চাইল্ড কেয়ার ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম এখলাসুর রহমান।

পুরস্কার

শিক্ষা, চিকিৎসা, শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষা, দুর্গত অসহায় মানুষের সেবাসহ সমাজকল্যাণমূলক কাজে অসামান্য অবদান রাখায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ডা. এম আর খানকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী স্বর্ণপদক দেয়।




















-----------------------------------------------


Share:

0 comments:

Post a Comment

Definition List

Unordered List

Support

সকল