ডাক্তাররা সমাজের চোখে ভিলেনে পরিনত হয়ে চলেছেন।
তারা মারামারি করেন।
তারা চামার।
তারা হৃদয়হীন।
তারা রোগীদের অবহেলায় আর ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুমুখে ঠেলে দেন।
তারা অমানুষ।
এত অভিযোগের সবগুলির সাথে একটি প্রশ্নের উত্তর নেই।
ডাক্তার ধরে ধরে মারলে কি সমস্যার সমাধান হবে?
এতগুলি অভিযোগের ও সমস্যার পেছনের কারনের কোন মীমাংসা নেই। কেবল শাস্তি নিয়ে সকলের আগ্রহ।
সমাজ থেকে ডাক্তার তাড়িয়ে দিলে কি সমস্যা মিটবে?
ডাক্তার পিটিয়ে স্ট্যাটাস দিলে কি সমস্যা মিটবে?
বছরের পর বছর ডাক্তারদের সমস্যাগুলি সমাধান না করে, ডাক্তারদের সংগঠনগুলিকে দলীয় লেজুড় বানিয়ে ফেলেছেন আমাদের রাষ্ট্র ও চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ।। এখন তার ফলাফল ভোগ করতে হচ্ছে সকলকে। নিরীহ চিকিৎসকরা মার খাচ্ছেন আর নিরীহ রোগীরা ভুগছেন।
১. যে কোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য চাই সঠিক ব্যবস্থাপনা।বাংলাদেশে সরকারী ও বেসরকারী সকল চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান আন্ডার স্টাফড বা প্রয়োজনের তুলনায় কর্মী ও সেবা নিয়ে সক্ষম নয়।
ঢাকা মেডিকেলের রেডিওলজী বিভাগ তার সকল রোগীর এক্সরে করতে সক্ষম না। ব্লাড ব্যাংক এর আকার তার বেড সংখ্যার তুলনায় ক্ষুদ্র। কিচেন বলতে কিছু নেই। ভবনটির রক্ষনাবেক্ষন করে সরকারের আরেকটি বিভাগ। নার্স ও চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের উপর চিকিৎসকদের কোন নিয়ন্ত্রন নেই। ঔষধের সরবরাহ ও বেড সংখ্যা রোগীর তুলনায় কম। ওয়েস্ট ডিসপোজাল বা আবর্জনা ব্যবস্থাপনা অবৈজ্ঞানিক।
উর্দিপরা ব্যক্তিরা সব হাসপাতালের ডিরেক্টর। যেন পোষাকেই ভক্তি, পোষাকেই মুক্তি। হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট নামক বস্তটি রাষ্ট্রের ও হাসপাতাল মালিকদের অজানা।
২. ইন্টার্নিরা প্রতি বছর ১৫০ জন আসে আর যায়। । অনারারী মেডিকেল অফিসারেরা নিজেরে পকেটের পয়সা দিয়ে সেখানে চিকিৎসা দেয়।
৩. মেডিকেলের ভালো ছাত্র হওয়া না হওয়ার সাথে তার চাকুরীর বা পোস্টিং এর কোন সম্পর্ক নাই। আমি প্রফে স্ট্যান্ড করেও পোস্টিং পেয়েছিলাম ইউনিয়নে আর আমার সংগে এক বছর পরে পাশ করা ছাত্র নেতার চাকুরী হয়েছিল বিএসএমএমইউতে।
আমাদের ক্লাসের সেরা ছাত্রীটিও সেই সময় আমারি সাথে ছিল, চাকুরী হয় নি তারো।
মরহুম প্রফেসর কাদরী আমাকে চাকুরী দেন নাই, কারন আমার নামের পাশে তদবির ছিল না।আমি বুঝি নাই, যোগ্যতা হলো তদবির , রেজাল্ট হলো ফালতু জিনিষ।
বিসিএস চাকুরীতে দেখলাম আমার থাকার জায়গা নেই আর তদানীন্তন স্বাস্থ্য সচিব এর মেয়ের জামাই যেহেতু টাংগাইলে তাই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোয়ার্টারের বারান্দায় সরকারী পয়সায় গ্রীল লাগানো হচ্ছে , চুনকাম হচ্ছে। কারন তারা সেখানে উঠবেন।
কমপ্লেক্সের দুটো কোয়ার্টারে ভাড়া থাকেন, সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার ও পল্লী বিদ্যুতের জি এম।
গ্রামে চাকুরী করলে ডাক্তারের ট্রেনিং কাউন্ট হয় না।
ডাক্তার হয়ে পড়ে এক হতাশ, বিরক্ত ও বিষন্ন মানুষে।
৪. এই সব অব্যবস্থাপনা ১৯৯৬ সালের গল্প। ১৮ বছর পরে দেশে এখন ৮৩ টি মেডিকেল কলেজ। এখনো একজন এমবিবিএস এর অবস্থা একই রকম। তার ক্লিনিকে বেতন ঘন্টায় ১০০ টাকার কম।
৫. হাসপাতালে একজন রোগীর সাথে আসে ১০ জন আত্মীয় পরিজন।কারন তাদের দৌড়াদৌড়ি করতে হয় সবকিছুর জন্য। ঔষধ থেকে শুরু করে খাবার। ইনফেকশন কন্ট্রোল করতে হিমসিম খায় চিকিৎসকেরা।রোগীর অপারেশন ঠিকমতো হয়, ইনফেকশনে রোগী মরে যায়।
হাসপাতালে প্রবেশে কোন বিধিনিষেধ মানা হয় না। এমনকি চিকিৎসকের লিফটে চড়ে বসে রোগীর বন্ধুরা। না করলে ডাক্তারকে ধরে মারে।
৬. কোন হাসপাতালে ডাক্তারের কোন প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই। একজন নার্স যদি কর্তব্যে অবহেলা করে তবে তার এসিআর নামক বস্তটিতে চিকিৎসকের কোন মন্তব্যের ঘর নাই।
আমার মনে আছে অত্যন্ত রুপবতী এক নার্স আমার ডিউটির সময় লম্বা লম্বা নখ নিয়ে, ডিউটি সিস্টারের টেবিলের উপর পা তুলে নেলপলিশ লাগাচ্ছিলেন। তিনি আবার আমার এক মেডিকেলীয় বড়ভাই এর সাথে ঈষৎ ভালোবাসার অভিনয় করতেন। আমি তাকে ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে নেলপলিশ লাগিয়ে আসতে বলায় তিনি মেট্রনের কাছে এমন ভংগীতে বিচার দিতে গেলেন যে আমি কথাটা বলে তাকে ভিষন অপমান করেছি।
মেট্রনকে বলে আমি তাকে আমার ওয়ার্ড থেকে চিরবিদায় দেবার পরে আমার সেই বড়ভাই আমাকে এসে বলেন, তোমার ভাবীর সাথে এরকম করাটা তোমার ঠিক হয় নাই।পরে অবশ্য ময়লা নখের কারনেই হয়তো তিনি আর আমার ভাবী হতে পারেন নাই।
এই হলো মেডিকেলের হাল হাকিকত।
ব্যবস্থাপনার খোল নলচে বদলে আধুনিক নিয়ম কানুন না আনলে এইসব চলতেই থাকবে।
*এখন সিস্টাররা অভিযোগ করেছেন সিলেটে এক ইন্টার্নি নাকি ছাত্রী সিস্টারকে মেরেছেন।
*সাংবাদিক ও ডাক্তাররা লাঠি হাতে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া দিচ্ছেন।
*রোগীর আত্মীয় ডাক্তার মেরে ফেসবুকে স্ট্যটাস দিচ্ছেন।1
*লিফটে ওঠা নিয়ে বচসা ও মারামার করছেন রোগীর বন্ধুরা ও ডাক্তাররা।
*ভাত খেতে গিয়ে মার খেয়ে আইসিইউতে গেছেন ঘটনার সাথে সম্পর্কহীণ ডাক্তার।
***এটা চুড়ান্ত অরাজকতা।
এর কারন হতাশা, ডিস্যাটিসফ্যাকশন এবং অবিচার। মেধাবীদের বিচার যেখানে দলের পাল্লায় তেলের বাটথারা দিয়ে হয়, সেখানে অযোগ্যতা থাকবে। থাকবে হাহাকার।
সেখানে এরকম হতেই থাকবে।
আমার কথা বিশ্বাস না হলে গত ২৪ বছরে পোস্টিং , প্রমোশন, ট্রেনিং, স্কলারশীপ ও বিদেশ যাত্রার তালিকা পরীক্ষা করে দেখেন।
দলীয়কৃত , একচোখা , স্বজনপ্রিয় চিকিৎসকদের নেতৃত্ব কখনোই কর্মস্থলে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ও চাকুরীর সন্তষ্টি দিতে পারবেন না।
অসন্তষ্ট মানুষের কাছ থেকে দয়া মায়া প্রেম আশা করা যায় না।
সেটা কোথাও না। কোন পেশাতেই না।
তাই সচিবালয়, পুলিশ, বিডিআর, কাস্টমস, কোথাও কেউ ভালো ব্যবহার করে না।
ফলে ভুল চিকিৎসা , অবহেলা, দুর্ব্যবহার সবই চলতে থাকবে।
আর জীবনের নিরাপত্তা তো বাড়ীতে নেই, রাস্তাতেও নেই।উপজেলা চেয়ারম্যান এর গাড়ীর ছবি দেখুন, সাগর রুনির কথা মনে করুন। নারায়নগঞ্জের ৭ খুন দেখুন।
অন্য সরকারী কর্মকর্তারা তবু নিজের অফিসে নিরাপদ। চিকিৎসকের নিরাপত্তা তার কর্মস্থলেও নেই।
কর্মস্থলে নির্যাতিত হয়ে মরলেন যে চিকিৎসক, তার অপরাধীর শাস্তি হয়েছিল?
স্বামীর হাতে মার খেয়ে মরলেন যে চিকিৎসক?
এই যে সেদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মরলেন আরেকজন? তার পরিবারকে কে ক্ষতিপুরন দেবে?
কেবল রানা প্লাজাতে মরলেই ক্ষতিপুরন?
রানা প্লাজার সময়ে মেডিকেলের ভাইবোনরা যা করেছিলেন, তারা গাড়ীচাপা পড়লে সমাজ কি সেই সেবা তাদের বেলায় করে?
আমার সি এ, এলিন ভাই যে দু পা ভেঙে পড়েছিলেন বিছানায়, কর্মস্থলে যেতে গিয়ে, তার চিকিৎসার খরচ কে দিয়েছিল? সরকার?
আসুন প্রার্থনা করি
হে মহান স্রষ্টা! তোমার ”শেফার হাত, নিরাময়ের গুণ” যাদের হাতে তুমি ন্যস্ত করেছো, তোমার দয়া মায়া যাদের মধ্য দিয়ে তুমি প্রকাশিত করো রোগীর কাছে, তাদের তুমি ধৈর্য দাও। তাদের তুমি রক্ষা করো্।
এছাড়া আর কিইবা বলার আছে?
Dr. Abdun Noor Tushar
22.May.2016